×

দাতা কর্ণ

Ajoy Chitrakar

মহাকাব্য মহাভারতে অজস্র চরিত্রের সমাহার। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কুন্তীপুত্র কর্ণ। তাঁকে ‘দানবীর’ বলা হয়। তিনি লোকহিতৈষী, দানে অকুণ্ঠহস্ত। এই পটে কর্ণ ও কৃষ্ণের একটি কাহিনী বলা হয়েছে। কৃষ্ণ পরীক্ষা করয়ে চাইলেন কর্ণ যথার্থই দানবীর কি না। তিনি ব্রাহ্মণের বেশে কর্ণের কাছে উপস্থিত হলেন। দান হিসেবে প্রার্থনা করলেন কর্ণের পুত্রকে – তাঁর মাংস খাবেন বলে! কর্ণ তখন তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতীকে রাজি করালেন তাঁদের স্বীয় পুত্রকে রন্ধন করতে, সেই ব্রাহ্মণের অনুরোধ রক্ষার্থে। কৃষ্ণ সন্তুষ্ট মনে জীবন ফিরিয়ে দিলেন কর্ণ ও পদ্মাবতীর পুত্রের।

গান

বৈশম্পায়ন বলে রাজা জন্মেজয়

মহাভারতের কথা অমৃত আলয়

একদিন বসুদেব ভাবিল অন্তরে

কর্ণ যে কেমন দাতা বুঝিবো তাহারে

যে যা মাগে কর্ণ তাহা দেয় দান

সবে বলে দাতা নাহি কর্ণের সমান

একদিন যাবো আমি কর্ণের নিকটে

দেখিব কেমন রাজা সেই বীর বটে

এই কথা মনে মনে ভাবে নারায়ণ

মায়া ছলিবারে হইল বৃদ্ধ যে ব্রাহ্মণ

অতি বৃদ্ধ রূপ হইল দুই চক্ষু অন্ধ

কর্ণকে ছলিতে গেল প্রভু কৃষ্ণচন্দ্র

চলিতে শক্তি নাই তার কাঁপে থর থর

কর্ণের নিকটে গেল প্রভু গদাধর

দ্বারীকে ডাকিয়া কর্ণ মধু চক্রপানি

মোর সমাচার কর্ণে জানাহ আপনি

বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ দেখে দ্বারীর ভউ হইল চিতে

কর্ণরে চলিল দ্বারী সমাচার দিতে

প্রণাম করিয়া দ্বারী জোড় হস্তে কয়

দ্বারেতে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ মহাশয়

মোর সমাচার কর্ণে বলে দ্বিজবর

তোমারে আশিষ্য করে ফিরে যাবে ঘর

হেন বৃদ্ধ নাহি দেখি আপনার জ্ঞানে

বুঝিয়া করহ কার্য যাহা লয় মনে

ওই যে তুমি দেখো ব্রাহ্মণের কথা

ওই তখনি সে চলি যে যেখানে বারতা

কথে শুনে কর্ণ সে যে গেল যে চলিয়া

ও আবার সব কথা ব্রাহ্মণ এসে দিল যে বলিয়া

প্রণাম করিয়া প্রভু জোড়হস্তে কয়

কোন কাজেতে আগমন বলুন মহাশয়

মোর সমাচার কর্ণে বলে দ্বিজবর

তোমারে আশিষ্য করে ফিরে যাব ঘর

কি কারণে এসেছ বাবা বল না এখন

এই কথা কর্ণ দেখ বলেছে বচন

বসিতে আসরে গিয়ে জোড়হস্তে কয়

কোন কাজে আগমন বলুন মহাশয়

কর্ণ বলেন ওগো প্রভু শুন আমার বাণী

কি কারণে এসেছ যে বলগো এখনি

ব্রাহ্মণ বলেন কর্ণ হও সাবধান

দাতা ছলিবারে এলো প্রভু ভগবান

হাসিয়া কর্ণকে দেখে দ্বিজবর কয়

পালন করাহ কর্ণ বিড়ম্বনা সয়

কল্য করিয়াছি আমি ব্রত একাদশী

পালন করাহ কর্ণ আছি উপবাসী

আর এক আছে মোর মনের বাসনা

মাংস বিনে নাই হয় ব্রতের পালন

মৃগ মাংস পক্ষী মাংস আনিব প্রচুর

যা মাংস খাইতে চাও ব্রাহ্মণ ঠাকুর

ব্রাহ্মণ কহেন কর্ণ মূল বিবরণ

তুমি কিন্তু আগে সত্য করহ এখন

কর্ণ কহে সত্য সত্য সত্য করি দান

যা মাংস খাবে বলো ওগো ও ব্রাহ্মণ

বিশ্বকেতু নামে আছে তোমারি নন্দন

তারে কেটে দিবে মাংস করিব ভোজন

মাতা পিতা দুই জনেতে কাটিবে করাতে

হাসিয়া কাটিয়া দিবে আমার সাক্ষাতে

কাতরে কাটিয়া দিলে ফিরে যাব ঘর

সেই কথা বলি আমি ওই দ্বিজবর

সেকথা শুনিয়া কর্ণ মহামতী

চলিলেন যেখানে দেখো আছে পদ্মাবতী

বিরস বদন দেখে পদ্মাবতী কয়

মুখে নাহি স্বরে বারি চক্ষে ধারা বয়

কর্ণ কহে আরো কিবা দেখো পদ্মাবতী

এতদিন পরে আমার হইল অখ্যাতি

কোথা থেকে এলো এক বৃদ্ধ যে ব্রাহ্মণ

বড় নিদারুণ কথা বলিল সে জন

হাসিয়া কাটাইব পুত্র না হব কাতর

কাতরে কাটিয়া দিবে ফিরে যাবে ঘর

শুনে ওরে পদ্মাবতী বলে বারেবার

কি কথা শুনাবে ওগো, ওগো প্রভু আর

শুন শুন ওগো প্রভু বল হে ব্রাহ্মণে

আপনি কাটিয়া দিবে আপনার মনে

এদিকে যে দ্বিজবর দ্বার দিয়া কয়

পালন করাহ দেখ শুন মহাশয়

অঙ্গীকার করিয়াছ শুন কর্ণ ভাই

না পারো রাখিতে তাহার গৃহে ফিরে যাই

কর্ণ বলে জগৎ প্রভু বইস রে এখুনি

একবার দেখ বুঝি দাও অনুমতি

দাতা কর্ণের নাম তুমি রাখো পদ্মাবতী

আপনি কাটিয়া দিবে আপনার মনে

এই কথা তুমি গিয়ে বল না ব্রাহ্মণে

অনুমতি পেয়ে কর্ণ হাসে খলখল

দ্বিজ কবিশ চন্দ্র গায় গোবিন্দ মঙ্গল

কর্ণ বলে দ্বিজবর বইস হে এখুনি

ক্ষণেক বিলম্ব কর পুত্র ডাকি আমি

ইহা বলে যান কর্ণ পুত্র ডাকিবারে

বৃষকেতু শিশুর সঙ্গে খেলিছে বাজারে

কোথায় বাছা বৃষকেতু ডাকে ঘন ঘন

খেলা ছাড়ি একবার এসো বাছাধন

কথা শুনে দেখ তবে বৃষকেতু এল

পথ হইতে ফিরিয়া যে সেই পুত্র গেল

বলে শুন ফিরে এলাম ওগো সঙ্গিগণে

খেলিতে আসিব আসিব আমি কি লইয়া মনে

খেলতে আমি আসব দেখ বেঁচে থাকি ভাই

নতুবা তোমার কাছে হইনু বিদায়

অনিত্য শরীর ভাই পদ্মপত্র জল

মানুষ শরীর ভাই রে যায় রসাতল

বেঁচে যদি থাকি ভাই আসিব খেলিতে

নতুবা বিদায় হইলাম তোমাদের সাক্ষাতে

চমৎকার কথা শুনে যত শিশুগণ

হেন বাক্য তব মুখে না শুনি কখন

এই বলে বৃষকেতু তখন আসিল

এসো বাছাধন বলিয়া কোলেতে করিল

কোলে করে নিয়ে যায় কর্ণ মহামতি

পুনরায় নিলো কোলে যথা পদ্মাবতী

এসো রে অভাগী বাছা আমার কথা রাখো

চাঁদমুখে একবার মা বলিয়া ডাকো

বৃষকেতু বলে মাগো নিবেদি চরণে

কিসের লাগিয়া মা গো কাঁদো কি কারণে

এমন কথারে বাবা বলা নাহি যায়

এমন কথারে বাবা বলা নাহি যায়

মুখে নাহি সরে বাণী চক্ষে ধারা বই।

বলে শুনে ওগো মাতা ওই নিবেদি চরণে,

কেন কাঁদো বল মাগো বলো এইখানি।

তোমার মাতাপিতা দুইজন কাটিব করাতে,

রন্ধন করে দিতে হবে ব্রাহ্মণ সাক্ষাতে।

হাসিয়া কাটিব আমরা না হবো কাতর,

কাতরে কাটিয়া দিলে ফিরে যাবে ঘর।

বৃষকেতু বলে মাগো এতো ভাগ্য হবে,

এই অভাগার মাংস নাকি ব্রাহ্মণে খাইবে।

বৃষকেতু বলে শোনো আজি মোর শুভদিনও,

এমন দিনে ভবে আসে না কখনও।

আমার মাংস খাবে কি ব্রাহ্মণে,

ব্রাহ্মণও যে জন্মালি, সেই পায়ে নারায়ণে।

শুনে মাতা কহি তব ঠাঁই,

ব্রাহ্মণ বর্ণের রাজা, সকলের করে পূজা।

ব্রাহ্মণ গোবিন্দ ভেদ নাই,

হাসিয়া কাটিয়ে দাও, ব্রাহ্মণে খুশি করাও,

মরবে বাপে পাপে পুণ্য ফলে।

দ্বিজ যদি রুঠে যায়, কি করিব যায় উপায়,

মরবে পাপে ব্রহ্মশাপ দিলে।

তখন যে মাতাপিতা দুইজনে দাঁড়ালো,

করতে কাটিয়ে ও যে মুন্ড সে কাটিল।

বলে কাটিয়া মাংস দেখো যে রন্ধন করিল,

পুনরায় ব্রাহ্মণ তাকে ডাকিয়া কহিল।

শুন শুন ওগো তবে কর্ণ তুমি ভাই,

অম্বল বিফলে অন্ন খেতে পারি নাই।

একখানি মাংস নাহি রেঁধেছি সকল,

কি রাঁধিবো প্রভু বলগো অম্বল।

ব্রাহ্মণ বলেন কর্ণ বলি তোমার কাছে,

পদ্মাবতী পুত্রের মুন্ড লুকাই রেখেছে।

রাজা বলে ওগো রানী শুন হে আমার বাণী,

কপট কর কি ওই লাগিয়া,

যে পুত্রে ব্রাহ্মনে দিলে মুন্ড কি রাখিলে,

মুন্ড কেন রাখো লুকাইয়া।

সেই মুন্ড আনিয়া যে করিল অম্বল,

দ্বিজ কবিশ চন্দ্র গে গোবিন্দ মন্ডল।

কিছুক্ষণ দেখে বলে শুন কর্ণ ভাই,

আমার জন্য করতে হবে ওই চার ঠাঁই।

চারজনের জায়গা কর খাইবো চারজন,

বাজার হইতে নিয়ে এসে পুত্র একজন।

ব্রাহ্মণের কথা কর্ণ না করে হেলন,

জয় আজ্ঞা বলে রাজার দিলো দরশন।

মনের দুখে কর্ণ দেখে চারদিকে চায়,

ও তার নিজ পুত্র বৃষকেতু দেখিতে সে পায়।

পুত্র যে কে শোকে দুঃখে কোলে তুলে নেয়,

ছুটে এসে পড়ল কর্ণ ব্রাহ্মণেরও পায়।

সত্যিকারের পরিচয় দিও আপনি,

নচেৎ ওই চুরি দিয়ে মরবো রাজরানী।

ব্রাহ্মণ বলেন কর্ণ না চিনো আমারে,

এসেছিলাম নারায়ণ ছলিবার তরে।

আপনি যদি সত্যিকারে ওগো নারায়ণ,

দয়া করে নিজ মূর্তি দেখাও গো এখন।

শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম দেখাল তখন,

ওই শঙ্খ পদ্ম চক্র তারা দেখে তিনজন।

মহাভারতের কথা অমৃত সমান,

কাশীরাম দাসে বলেন শুন পুণ্যবান।