এই পটকাহিনীতে চাঁদ সদাগর ও মনসার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এইখানে ভারতীয় নারীত্বের এক ধারক-চরিত্র বেহুলার প্রসঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কাহিনী শুরু হচ্ছে বণিক চাঁদ সদাগরের সঙ্গে সর্পদেবী মনসার দ্বন্দ্ব দিয়ে, এবং কাহিনীর শেষে সেই চাঁদ মনসার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠছেন। চাঁদসদাগর ছিলেন শিবের উপাসক। কিন্তু মনসাদেবী চাইতেন যে চাঁদ তাঁরও অর্চনা করুক। কিন্তু চাঁদ মনসাকে দেবী হিসেবে গণ্য করতেও অস্বীকার করলেন। চাঁদের সাত পুত্র ছিলো, তাঁদের মধ্যে ছয়জনের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিলো। ক্রুদ্ধ মনসার মনে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠলো। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে সেই সাত পুত্রের প্রাণনাশ করবেন। চাঁদের সপ্তম পুত্র লখীন্দরের বিবাহ হয় সায়বেন বণিকের কন্যা বেহুলার সঙ্গে। বিয়ের রাত্রে লৌহবাসরে লখীন্দর সর্পদ্রংষ্ট হলেন। নববধূ বেহুলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন লখীন্দর ও তাঁর ছয় ভাইয়ের পুনর্জীবিত করে তুলবেন। তাঁর চরিত্রবল, সাহস এবং গভীর ভক্তির সামনে সর্পদেবী নতিস্বীকার করলেন। জীবন ফিরে পেলো চাঁদের সাত পুত্র।
ও তুই কেন এলি সরোবরে বেহুলা সুন্দরী
ও তোর পায়ের জল মোর গায়ে পড়িল আমি বিষহরি
ও তুই কেন এলি সরোবরে বেহুলা সুন্দরী
ও তোর বাসর ঘরে মরবে পতি হবি কুলে রাঁড়ি
ও তুই কেন এলি সরোবরে বেহুলা সুন্দরী
মনসা জগৎগৌরি জয় বিষহরি
পদ্মফুলে জন্ম নিলো মনসা কুমারী
নাগের হইলো খাটপালঙ্ক নাগের সিংহাসন
মঙ্গলা বরার পৃষ্ঠে দেবীর আসন
তরজে গরজে বেণা মোচড়ায় দাড়ি
গালি দিলো মা মনসারে ঢেমনা শয়তানী
ও বিটি ঢেমনার নাগাল যদি পাই
মারিব হেতালের বাড়ি কোমড় কুচাই
সেই গাল বিষহরি আপনি শুনিল
ক্রোধ ভরে চাঁদ বেণার ছয় পুত্র খেলো
ছয় পুত্র খেলো তার ছয় বউ হইলো রাঁড়
জন্মে নাহি দিবে বেণা __র পুষ্প দান
আছে যে কোলের পুত্র দুলাল লখীন্দর
তার বিবাহ দিতে চলো নিছনী নগর
নিছনী নগরে ঘর অমূল্য বেণারই
তার মেয়ের নাম রেখেছে বেহুলা সুন্দরী
সম্বন্ধ জুড়িতে গেল বুড়া জনার্দন
সম্বন্ধ ঘুচাইয়া মরে সেই আঁটকুরা
বিয়ে হলো লখীন্দর পালকিতে চড়িল
আগুড়ি পিছুড়ি কাহার কাঁধে করে নিলো
সান্তালী পর্বতখানি লোহার বাসরঘর
তাতে শুয়ে নিদ্রা যায় ক্লান্ত লখীন্দর
শোনো গো ও রামা সায়বেণার ঝি
ভোরে এল কালনিদ্রা আমায় খেলো কি
কী হল কী হল আমার বাসরঘরে পতি মরলো কী হলো
সোনার বরণ স্বামী আমার বিষেতে নীলবর্ণ হলো
আমি যদি হই মা সতী বাঁচাইবো মরা পতি
আমার ভাগ্যে এই দুর্গতি কালযমুনায় ভাসতে হলো
কী হল কী হল আমার বাসরঘরে পতি মরলো কী হলো
আমার ভাগ্যে এই দুর্গতি কুলে রাঁড়ি হতে হলো
উঠ না গো ওগো রামা সায়বেণার ঝি কী হলো
ধরে এলো কালনিদ্রা আমায় খেলো কী
আঁচল ছিঁড়িয়া কন্যা জ্বালিলেন বাতি
সাপেরে ফিকিয়া মারে সুবর্ণের জাতি
ল্যাজ কাটা গেল সাপের আড়াই আঙুল
সাপিনী পালায়ে গেল ব্যথায় আকুল
দৌঁড়ে গিয়ে নেড়া নফর সওদাগরে কয়
তোমার পুত্র মারা গেছে শুনেন মহাশয়
চাঁদের ছেলেকে সাপে খেয়েছে
ওঝা নাহি দেশে তারে বাঁচাইবে কে
দৌঁড়ে গিয়ে নেড়া নফর সওদাগরে কয়
তোমার পুত্র মারা গেছে শুনেন মহাশয়
ভালো হইলো আমার পুত্র লখীন্দর মোলো
হেতাল লাঠি নিয়ে বেণা নাচিতে লাগিলো
কতক্ষণ হবে নেড়া রজনী প্রভাত
চেঙ পাছ পুড়া করে খাবো পান্তাভাত
দিয়েছিলে শাঁখা শাড়ি লও খসাইয়া
কলার মান্দাস করে দাও সাজাইয়ে
একখানি রাম কলার গাছকে তিনখানি করিলো
বাঁশের গজাল মেরে বেহুলা ভাসিলো
ভাসিতে ভাসিতে মন্দাস কতোই দূরে গেল
হেনকালে বেহুলার ছয়টি ভাই এলো
ভাই বলে ওগো দিদি প্রাণেরই ভগিনী
পচা মড়া নিয়ে কেন জলে ভাসো তুমি
ঘরকে ফিরে চলো গো দিদি আমরা সেবা নেবো
ঘরে আছে ছয় ভাজ নীচে খাটাইবো
অভাগীর ঘর নাই দাদা আর নয়কো সাজে
কুঁদুলে ভাজেদের সঙ্গে সদাই দ্বন্দ্য বাঁধে
অল্প বয়সে দাদা হলাম কুলে রাঁড়ি
আর নাহি ফিরে যাব মা বাপের বাড়ি
ভায়েদের কে পরিবোধ দিয়া ভাসিয়া চলিলো
গদা ঘাটে গিয়ে মড়া খেলিতে লাগিলো
গদা বুড়া বঁড়শিয়ারে গাঙুড়েরই জলে
শুধু অন্ন খায় না গদা রুইমাছ ধরে
বলিস নে ওরে ও গদা বলিস নে কুবাক্যবাণী বলিস নে
ক্ষণে গো এই দেখবি রে গদা বাঁচিয়ে আনবো মরা স্বামী
গদা বুড়া বঁড়শিয়ারে গাঙুড়ের জলে
শুধু অন্ন খায় না গদা রুইমাছ ধরে
যুবতিনী দেখে গদা করেন উপহাস
বলো বলো সীমন্তিনী কোন দেশে বাস
ও গো সুন্দরী তুমি আমার কথা ভাবো
স্বামী বাঁচায়ে দেবো আমি আমার কাছে আস গো
তোর মুখে ছাই রে গদা তোর মুখে ছাই
মা মনসার দাসী আমি জলে ভেসে যাই
গদারে পরিবোধ দিয়ে ভাসিয়া চলিলো
তমলুকের ঘাটে মড়া খেলিতে লাগিলো
ধনা মনা দুটি ভাই শুইয়া ছিলো খাটে
নেতই ধোবানী কাপড় কাচেন তমলুকের ঘাটে
নেতাই কাচেন কাপড় কাচোয়ার কূল
বেহুলা কাচেন কাপড় সূর্য সমতুল
নিজ হাতে কাপড়খানি শুকাইয়তে দিলো
বেহুলার কাপড়খানি উজ্জ্বল হইলো
ওই কাপড় নিয়ে বেহুলা দেবপুরে গেলো
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিবের কাছে বর চেয়ে নিলো
“দিলাম বেটি বর বেহুলা দিলাম তোরে বর
মরা স্বামী বাঁচিয়ে দিচ্ছি যাও শ্বশুর ঘর
সাত ডিঙ্গা সাজাইলো মনেরও হরষে
মরা স্বামী বাঁচতে বেহুলা তবেই গেল দেশে
ডিঙ্গা ভাসাও সাগর সাথী রে ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে
পুবেরই আকাশ রাঙা হলো সাথী ঘুমায়ো না জাগো রে
ভাসাও রে ডিঙ্গা সাগরে
সাত ডিঙ্গা সাজাইলো মনেরও হরষে
মরা স্বামী বাঁচতে বেহুলা তবেই গেল দেশে
নাগের পৃষ্ঠে নৌকাগুলি ভাসিতে লাগিল
হংস বধি কেটে করে মা মনসার পূজা
ঢাক ঢোল দিয়া মায়ের পূজা তখন দিলো
বেহুলার মতো সতী কেহ না হইলো
সাত বউ সাত বেটা ঘরে ফিরে এলো
সেদিন থেকে মনসাপূজা সর্বঘরে হলো
এইখানেতে শেষ করিলাম কবিতার বন্দনা
আমরা পটুয়া যে নয়ায় হয় ঠিকানা